আজিজুল পারভেজ :: ১৯ মে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মহিমান্বিত একটি দিন। বাংলাদেশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঠিক ৯ বছর পর ১৯৬১ সালের এই দিনে ভারতের আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকায় রচিত হয় এক বেদনাবিধুর ইতিহাস। বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে আত্মবিসর্জন দেন ১১ জন বাঙালি। দিনটিকে আসামের বাঙালিরা ‘ভাষা শহীদ দিবস’ হিসেবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলা ভাষার এই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি পালন করা হয়।
জানা যায়, ভারতের ‘সেভেনসিস্টার’ এর অন্তর্ভুক্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম এক বহুভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। প্রদেশে অসমিয়া ভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংখ্যার হিসাবে ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্য সরকার ‘আসাম রাজ্যভাষা আইন ১৯৬০’ নামে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা আসামের ৪০ শতাংশের কম মানুষের ভাষা অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব করেন। এ আইন মোতাবেক আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে অসমিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় অন্যান্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ক্ষোভের সৃষ্টি হয় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। আসামের বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী হিসেবে বাঙালিরা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাকেও অন্যতম রাজ্যভাষা ঘোষণার দাবি জানায়। দাবি আদায়ের জন্য গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংগঠন। রাজপথে নেমে আসে ছাত্ররা। পালিত হতে থাকে একের পর এক আন্দোলন-কর্মসূচি। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিল উত্থাপনের শুরুতেই ১৯৬০ সালের ২৪ জুন থেকে শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। চলতে থাকে ছাত্র ধর্মঘট, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বর্জন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, করিমগঞ্জে সর্বদলীয় প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল কর্মসূচি। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ মে সর্বত্র বন্ধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনকে অচল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আন্দোলনকারী বাঙালিরা।
১৯ মে ভোর থেকেই ‘জান দেব, জবান দেব না’, ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। গোটা উপত্যকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। ধর্মঘটে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তা অমান্য করে ছাত্ররা বেরিয়ে আসে রাজপথে। শুরু হয় পুলিশি নির্যাতন এবং ধরপাকড়। বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে শিলচর তারাপুর রেলস্টেশনে ‘রেল রোখো’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ওপরে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী বিএসএফের জওয়ানরা গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে ৯ জনসহ শহীদ হন ১১ জন। তাঁরা হচ্ছেন কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাইলাল নিয়োগী, হীতেশ বিশ্বাস, সুনীল সরকার, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সহৃত্রধর, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্রদেব। সেদিন বিকেলে জনজোয়ার থামাতে কারফিউ জারি করা হয় শহরে। শুরু হয় লাগাতার সংগ্রাম, ভেঙে পড়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। টনক নড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের। ছুটে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। মুক্তি দেওয়া হয় রাজবন্দিদের। আলোচনায় স্থির হয় রাজ্য সরকারের সঙ্গে বাংলায় চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা যাবে। কাছাড়ের সব সরকারি বিল, অর্ডিন্যান্স, গেজেটের নোটিশ বাংলায় প্রচারিত হবে। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পর্যন্ত বাংলায় পড়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু মূল দাবি দাবিই থেকে যায়। বাংলা ভাষা অন্যতম রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়নি। ফলে তখনই শেষ হয়ে যায়নি আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন। ১৯ মের পথ ধরে তা এগিয়ে চলে। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, অসমিয়া হবে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম। ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ও এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আবারও প্রতিবাদ। মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষার অধিকার দাবি করে সোচ্চার হয়ে ওঠে বাঙালিরা। ১৯৭২ সালের ১৮ জুন আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হন বাচ্চু চক্রবর্তী। তার পরও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে মৃত্যু-মিছিল থামেনি। আবার রক্ত ঝরে ১৯৯৬ সালের ২১ জুলাই। বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনে মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু অসমিয়াকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অনুমোদন করা হলে বরাক উপত্যকাজুড়ে আবার শুরু হয় বাঙালিদের আন্দোলন। মুখ্যমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আরো দুই বাঙালি তরুণ। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শহীদের নাম। তাঁরা হলেন জগন্ময় ও দিব্যেন্দু। বাংলা ভাষার শহীদদের স্মরণে শিলচরে গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গড়ে উঠেছে শহীদ বেদি।
১৯ মে আসামের শিলচরসহ বাঙালি অধ্যুসিত বরাক উপত্যকায় নানামাত্রিক অনুষ্ঠানমালায় বাংলা ভাষার শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েও সেখানকার শহীদ মিনারগুলোতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
একইভাবে অনেকটা নীরবে হলেও ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও ১৯ মের বাংলা ভাষার শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ‘ভাষা আন্দোলন স্মৃতি পরিষদ’ নামক একটি সংগঠনের কর্মীরা ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১৯ মে সকালে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে আসছে। অবশ্য বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইসার সংক্রমন পরিস্থিতির কারণে এ বছর কোন কর্মসূচি ছিল না।
‘জালালাবাদ এসোসিয়েশনের শ্রদ্ধার্ঘ’
‘ এক বার্তায় জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকা’র সভাপতি ড. একে আব্দুল মুবিন বলেন ১৯ মে, বাংলা ভাষা শহীদ দিবস। এ দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আসামের বরাক উপত্যকায় প্রাণ উৎসর্গ করা সব ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীর প্রতি।
Leave a Reply